মাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন ছিল যৌথ পরিবার। দাদা-দাদি, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, চাচা–চাচি, তাদের সন্তান-সন্ততি ইত্যাদি সব মিলিয়ে গঠিত হত একটি পরিবার। আধুনিকতার নামে পুঁজিবাদী আগ্রাসনের ফলে এই ব্যবস্থা এখন চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার প্রহর গুনছে। শহরের মেকী চাকচিক্যে ঢাকা জঞ্জালেভরা জীবন আমাদের নৈতিক মূল্যবোধ-কে অন্ধ করে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, দৈনিক পত্রিকা কিংবা টেলিভিশন খুললেই দেখতে পাওয়া যায় পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশ পায় নির্যাতনের নির্মম চিত্র অথচ পৃথিবীর সকল ধর্ম সন্তানদের নির্দেষ দিয়েছে পিতা-মাতার সেবা শুশ্রষা করার।আর যখন এরূপ মূল্যবোধহীন মানুষগুলোর সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলছে এবং তাদেরকে শুধু ধর্মীয় ও নৈতিক বাণীতে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ঠিক সে সময়টিতে পিতা-মাতার যথোপযুক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে বিগত ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর প্রণীত হয়েছিল একটি আইন যার নাম শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে – পিতা মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩।

 “ভরণ-পোষণ” বলতে কি বুঝাবেঃ

 পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন- ২০১৩ অনুযায়ী ভরণ-পোষণ বলতে নিম্নোক্ত ৫ টি বিষয় কে বুঝাবে-

ক) খাওয়া-দাওয়া,

খ) বস্তু,            

গ) চিকিৎসা ও

ঘ) বসবাসের সুবিধা এবং

ঙ) সঙ্গ প্রদান; [ধারা-২ (খ)]

q  কোন কোন সন্তান পিতার-মাতার ভরণ-পোষণ দিতে বাধ্যঃ

প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে। কোন পিতা-মাতার একাধিক সন্তান থাকলে সেক্ষেত্রে সন্তানগণ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে তাদের পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করবে। [ধারা-৩(১,২)]  উল্লেখ্য যে এখানে সন্তান বলতে পিতার ঔরসে এবং মাতার গর্ভে জন্ম নেওয়া সক্ষম ও সামর্থ্যবান পুত্র বা কন্যা-কে বুঝাবে। [ধারা-২ (ঘ)]

পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিতকরণ পদ্ধতিঃ

·        পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতার একইসঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে। [ধারা-৩(৩)]

·        কোন সন্তান তার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তার, বা ক্ষেত্রমত, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, কোন বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করবে না। [ধারা-৩(৪)]

·        প্রত্যেক সন্তান তার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে। পিতা বা মাতা কিংবা উভয়, সন্তান হতে পৃথকভাবে বসবাস করলে, সেক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে নিয়মিতভাবে তার, বা ক্ষেত্রমত, তাদের সাথে সাক্ষাত করতে হবে। [ধারা-৩(৫,৬)]

·        কোন পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে, সন্তানদের সাথে বসবাস না করে পৃথকভাবে বসবাস করলে, সেক্ষেত্রে উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তার দৈনন্দিন আয়-রোজগার, বা ক্ষেত্রমত, মাসিক আয় বা বাৎসরিক আয় হতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা, বা ক্ষেত্রমত, উভয়কে নিয়মিত প্রদান করবে।[ধারা-৩(৭)]

পিতা-মাতা জীবিত নেই কিন্তু দাদা-দাদী কিংবা নানা-নানী জীবিত রয়েছে সেক্ষেত্রে করণীয়ঃ

পিতা মাতার অবর্তমানে প্রত্যেক সন্তান তার, (ক) পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদীকে; এবং (খ) মাতার অবর্তমানে নানা-নানীকে ভরণ-পোষণ করবে। [ধারা-৪]

 পিতা মাতার ভরণপোষণ প্রদান না করা এবং ভরণ-পোষণ নিশ্চিতে বাধা প্রদানের শাস্তিঃ

কোন সন্তান যদি পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ প্রদান না করা তাহলে তার.

                             ক) অনূর্ধ্ব ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে;

খ) বা উক্ত অর্থদণ্ড অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।[ধারা-৫(১)]

যদি কোন সন্তানের স্ত্রী, বা ক্ষেত্রমত, স্বামী কিংবা পুত্র-কন্যা বা অন্য কোন নিকট আত্মীয় ব্যক্তি; (ক) পিতা-মাতার বা দাদা-দাদীর বা নানা-নানীর ভরণ-পোষণ প্রদানে বাধা প্রদান করলে; বা (খ) পিতা-মাতার বা দাদা-দাদীর বা নানা-নানীর ভরণ-পোষণ প্রদানে অসহযোগিতা করলে— তিনি উক্তরূপ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছে গণ্যে উল্লিখিত দণ্ডে দণ্ডিত হবে। [ধারা-৫(২)]

৫ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধের প্রকৃতিঃ

এই আইনের অধীন অপরাধ; ক) আমলযোগ্য (cognizable), খ) জামিনযোগ্য (bailable) ও গ) আপোষযোগ্য (compoundable) হবে। [ধারা-৬]

অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণ ও বিচার করবে কোন আদালতঃ

Code of Criminal Procedure, 1898 (Act V of 1898) এ যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ ১ম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারযোগ্য হবে । তবে কোন আদালত এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট সন্তানের পিতা বা মাতার লিখিত অভিযোগ ব্যতীত আমলে গ্রহণ করবে না অর্থাৎ আমলে নেয়ার পূর্বশর্ত হলো পিতা-মাতা কর্তৃক লিখিত অভিযোগ [ধারা-৭]

এরূপ অপরাধের আপোষ – নিষ্পত্তির পদ্ধতিঃ

আদালত এই আইনের অধীন প্রাপ্ত অভিযোগ আপোষ-নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার, কিংবা ক্ষেত্রমত, সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার মেয়র বা কাউন্সিলর, কিংবা অন্য যে কোন উপযুক্ত ব্যক্তির নিকট প্রেরণ করতে পারবে। কোন অভিযোগ আপোষ-নিষ্পত্তির জন্য প্রেরিত হলে, সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান, মেয়র, মেম্বার বা কাউন্সিলর উভয়পক্ষকে শুনানীর সুযোগ প্রদান করে, তা নিষ্পত্তি করবে এবং এরূপে নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগ উপযুক্ত আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত বলে গণ্য হবে। [ধারা-৮]

এছাড়াও ধারায় আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বিধি প্রণয়নের বিধান অনুযায়ী পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ বিধিমালা, ২০২০ (খসড়া) এ প্রস্তুত করা হলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি।

পিতা-মাতার বদৌলতেই আমরা এই পৃথিবীর আলো দেখেছি এবং তারা আমাদের ছোট থেকে লালন-পালন করে এই সামজে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছেন কিন্তু আমরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই মাতা-পিতার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ-কে ভুল যাই। শুধুমাত্র বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা পিতা-মাতার প্রতি সন্তানদের প্রকৃত দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করা সম্ভব নয় বরং আইনের পাশা-পাশি ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষায় পারে প্রতিটি সন্তানের মধ্যে মাতা-পিতার প্রতি প্রকৃত দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করাতে…

মোঃ আরিফ হুসাইন

প্রভাষক, গাজীপুর সেন্ট্রাল ল কলেজ,
টঙ্গী লিগ্যাল এক্সিকিউটিভ, প্রিয়াংকা গ্রুপ